পপ গুরু আজম খানের গানের গল্প
আজম খানের গান রয়েছে বাঙালির শেকড়ে। সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি এখন না ফেরার দেশে। বাংলায় পপধারার গানকে জনপ্রিয় করে তুলতে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, অতুলনীয় এক কিংবদন্তি। তার গাওয়া অসংখ্য গান থেকে নির্বাচিত পাঁচটি গানের সৃষ্টির পেছনের গল্প তুলে ধরা হলো।
পাপড়ি কেন বোঝে না
পাপড়ি বাস্তব একটি চরিত্র। ১৯৭৫ সালে ঢাকায় কমলাপুরের ১২ জসীম উদ্দীন রোডের একটি বাড়ির দোতলায় পাপড়ি তার পরিবারের সঙ্গে ভাড়া থাকতেন। সেটা ছিল আজম খানের বড় ভাইয়ের বাড়ি। তখন তার উঠতি বয়স। মহল্লার ছেলেরা তাকে দেখলেই নানাভাবে বিরক্ত করত। স্থানীয় হিসেবে আজম খানের দাপট ছিল। পাপড়ির সঙ্গে বখাটেদের উক্ত্যক্ত করার কথা শুনে তিনি রাগান্বিত হলেন। একদিন তাদের ডেকে ধমক দিয়ে বললেন, 'আর কোনোদিন ওর দিকে চোখ তুলে তাকাবি না!' এরপর থেকে পাপড়ির সবকিছু খেয়াল রাখা যেন আজম খানের দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হলো। একদিন পাপড়িরা বাসা বদল করে চলে যায় অন্যত্র। তারপরই 'সারারাত জেগে কত কথা ভাবি আমি, পাপড়ি কেন বোঝে না তাই ঘুম আসে না' গানটির সৃষ্টি। সেটা ১৯৭৫ সালের কথা। এটা বিটিভিতে প্রথম ১৯৭৭ সালে পরিবেশন করেন আজম খান। তারপরই গানটি সুপারহিট হয়ে যায়। ১৯৮৪-৮৫ সালে চট্টগ্রামে একটা অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ একজন এসে তাকে জানালেন, তিনি পাপড়ির স্বামী। আজম খানকে ওই ভদ্রলোক জোর করে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। পাপড়ির সঙ্গে তার আবার দেখা হলো ১০ বছর পর। আজম খানের 'বাধা দিও না' গানটিও পাপড়িকে নিয়েই লেখা।
আলাল-দুলাল
এটা আড্ডারই গান। এ গানটা হলো তাদের বল্পুব্দদের সম্মিলিত প্রয়াস। কবি জসীম উদ্দীনের বাড়ির বাগানের দেবদারু গাছতলায় প্রতিদিনই তারা সব বল্পুব্দ আড্ডা দিতেন। গিটার নিয়ে টুংটাং করতেন। তার দুই বল্পুব্দ শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর আপন দু'ভাই। তাদের 'আলাল-দুলাল' বলে ক্ষেপাতো আরেক বল্পুব্দ আলমগীর। শাহজাহান হলো আলাল আর জাহাঙ্গীর হলো দুলাল। তারপরই 'আলাল-দুলাল' গানের সৃষ্টি। পপসম্রাট এ গান গাইলে লজ্জায় শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর মাথা নিচু করে থাকতেন। প্রথম প্রথম গাইতেন, 'আলাল-দুলাল, তাদের বাবা হাজি চান, প্যাডেল মেরে ওই পুলে পৌছে বাড়ি।' বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে তখন একটা পুল ছিল। তাদের আড্ডা থেকে পুলটা দেখা যেত। তার মেজ ভাই সঙ্গীত পরিচালক আলম খান গানটি শুনে বললেন, 'পুলের জায়গায় চানখাঁর পুল শব্দ দুইটা দে, শুনতে ভালো লাগবে।' তাই করলেন তিনি। একদিন ভাবলেন, গান যখন গাইছেন এটা নয় কেন? বিটিভিতে ১৯৭৫-৭৬ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জন্য গানটা রেকর্ড করলেন কাকরাইলের ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে। সে গানও রাতারাতি হিট। মজার বিষয় হলো, পুরান ঢাকার চানখাঁর পুলে সত্যি সত্যি 'হাজি চান' নামের এক মুরবি্ব ছিলেন। গান শুনে তিনি বেজায় খুশি। ভাবলেন গানটি বুঝি তাকে নিয়েই লেখা! তিনি আজম খানের এক বল্পুব্দকে পেয়ে বললেন, 'আজম খান তো গানটা জব্বর গাইছে। ওরে লইয়া একদিন মহল্লায় আহ।' তারপর বল্পুব্দরা মিলে একদিন তার বাড়িতে যান, গান করেন। পরবর্তী সময়ে অমিতাভ রেজা নির্মিত একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে 'আলাল-দুলাল' গানটি ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞাপনচিত্রের জন্য গানটি আবার গাইলেন আজম খান।
রেললাইনের ওই বস্তিতে
১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ লাগল। তখন কমলাপুর থেকে নটরডেম কলেজের ফুটপাত মানুষে ভরপুর। মানুষ মারা যাচ্ছে। কবর দেওয়ার মানুষ নেই। মা তার দুধের সন্তানকে রেখে পালিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষুধার জ্বালায় বাচ্চাকে বিক্রিও করে দিচ্ছেন। তখন নতুন নতুন গান করতেন আজম খান। ফুটপাতের বাচ্চাগুলো তাকে দেখলে মামা মামা বলে ডাকত। একদিন দেখেন এক বাচ্চা কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলেন, 'কী হইছে?' একজন বলল, 'মা বাচ্চাটারে রাইখা পলাইছে।' সব শুনে বুকটা ফেটে গেল। মনে মনে তখনই গানের লাইন খুঁজে পেলেন। লিখলেন, 'রেললাইনের ওই বস্তিতে...'। তারপর গাইলেন। এ গান আজও শ্রোতাদের আলোড়িত করে।
ওরে সালেকা ওরে মালেকা
এটি পাকিস্তান আমলের গান। জসীম উদ্দীন রোডে ঢুকতেই চিটাগাং হোটেলের পাশে ছিল টাওয়ার হোটেল। সেটা একতলা থেকে দোতলা হয়েছে। সেখানে একটা পানির ট্যাঙ্ক ছিল। আজম খানের বল্পুব্দ নীলু গিটার বাজাতেন। ছোট বাঁশের স্টিক দিয়ে পানির ট্যাঙ্কটাকে তিনি ড্রাম বানিয়ে বাজাতে লাগলেন। সেই রিদমের তালে তালে তারা পাঁচ-ছয় বল্পুব্দ মজা করছেন। নীলুর বিটের তালে কোনো ছাড়াই পপসম্রাটের মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো, 'ওরে সালেকা ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে'। এ গান নিয়ে পরে দেড় ঘণ্টা মজা করলেন তারা। এরপর ১৯৭৩ সালে তারা যখন পপ গান করেন, তখন হঠাৎ মাথায় এলো এ গানটাও তো করা যা! তারপর গানটা নতুন করে গাইলেন আজম খান। সেটাও সুপারহিট।
অভিমানী তুমি কোথায়
১৯৭৩ সালে এটি লেখেন আজম খান। তিনি খাতা-কলমে কোনোদিন গান লিখতেন না। হঠাৎ মাথায় এসে পড়লে মুখে মুখেই বানিয়ে ফেলতেন। তারা আড্ডা দিতেন চিটাগাং হোটেলের সামনে। সঙ্গে একটা গিটার থাকত। যেখানে গান করতেন সেখানে এক ভারতীয় পাগল ছিল। সে সুরে সুরে একটা গান গাইত আর নাচত, 'ইতলের বিনা, বিনারে ভাগি, বিনা চালা গ্যায়া।' ঠাণ্ডা পাগল ছিল। শুনে খুব মজা লাগত। এই গান থেকে তিনি পেয়ে গেলেন সুর। হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, 'অভিমানী, তুমি কোথায় হারিয়ে গেছো ...'।
পাপড়ি কেন বোঝে না
পাপড়ি বাস্তব একটি চরিত্র। ১৯৭৫ সালে ঢাকায় কমলাপুরের ১২ জসীম উদ্দীন রোডের একটি বাড়ির দোতলায় পাপড়ি তার পরিবারের সঙ্গে ভাড়া থাকতেন। সেটা ছিল আজম খানের বড় ভাইয়ের বাড়ি। তখন তার উঠতি বয়স। মহল্লার ছেলেরা তাকে দেখলেই নানাভাবে বিরক্ত করত। স্থানীয় হিসেবে আজম খানের দাপট ছিল। পাপড়ির সঙ্গে বখাটেদের উক্ত্যক্ত করার কথা শুনে তিনি রাগান্বিত হলেন। একদিন তাদের ডেকে ধমক দিয়ে বললেন, 'আর কোনোদিন ওর দিকে চোখ তুলে তাকাবি না!' এরপর থেকে পাপড়ির সবকিছু খেয়াল রাখা যেন আজম খানের দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হলো। একদিন পাপড়িরা বাসা বদল করে চলে যায় অন্যত্র। তারপরই 'সারারাত জেগে কত কথা ভাবি আমি, পাপড়ি কেন বোঝে না তাই ঘুম আসে না' গানটির সৃষ্টি। সেটা ১৯৭৫ সালের কথা। এটা বিটিভিতে প্রথম ১৯৭৭ সালে পরিবেশন করেন আজম খান। তারপরই গানটি সুপারহিট হয়ে যায়। ১৯৮৪-৮৫ সালে চট্টগ্রামে একটা অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ একজন এসে তাকে জানালেন, তিনি পাপড়ির স্বামী। আজম খানকে ওই ভদ্রলোক জোর করে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। পাপড়ির সঙ্গে তার আবার দেখা হলো ১০ বছর পর। আজম খানের 'বাধা দিও না' গানটিও পাপড়িকে নিয়েই লেখা।
আলাল-দুলাল
এটা আড্ডারই গান। এ গানটা হলো তাদের বল্পুব্দদের সম্মিলিত প্রয়াস। কবি জসীম উদ্দীনের বাড়ির বাগানের দেবদারু গাছতলায় প্রতিদিনই তারা সব বল্পুব্দ আড্ডা দিতেন। গিটার নিয়ে টুংটাং করতেন। তার দুই বল্পুব্দ শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর আপন দু'ভাই। তাদের 'আলাল-দুলাল' বলে ক্ষেপাতো আরেক বল্পুব্দ আলমগীর। শাহজাহান হলো আলাল আর জাহাঙ্গীর হলো দুলাল। তারপরই 'আলাল-দুলাল' গানের সৃষ্টি। পপসম্রাট এ গান গাইলে লজ্জায় শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর মাথা নিচু করে থাকতেন। প্রথম প্রথম গাইতেন, 'আলাল-দুলাল, তাদের বাবা হাজি চান, প্যাডেল মেরে ওই পুলে পৌছে বাড়ি।' বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে তখন একটা পুল ছিল। তাদের আড্ডা থেকে পুলটা দেখা যেত। তার মেজ ভাই সঙ্গীত পরিচালক আলম খান গানটি শুনে বললেন, 'পুলের জায়গায় চানখাঁর পুল শব্দ দুইটা দে, শুনতে ভালো লাগবে।' তাই করলেন তিনি। একদিন ভাবলেন, গান যখন গাইছেন এটা নয় কেন? বিটিভিতে ১৯৭৫-৭৬ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জন্য গানটা রেকর্ড করলেন কাকরাইলের ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে। সে গানও রাতারাতি হিট। মজার বিষয় হলো, পুরান ঢাকার চানখাঁর পুলে সত্যি সত্যি 'হাজি চান' নামের এক মুরবি্ব ছিলেন। গান শুনে তিনি বেজায় খুশি। ভাবলেন গানটি বুঝি তাকে নিয়েই লেখা! তিনি আজম খানের এক বল্পুব্দকে পেয়ে বললেন, 'আজম খান তো গানটা জব্বর গাইছে। ওরে লইয়া একদিন মহল্লায় আহ।' তারপর বল্পুব্দরা মিলে একদিন তার বাড়িতে যান, গান করেন। পরবর্তী সময়ে অমিতাভ রেজা নির্মিত একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে 'আলাল-দুলাল' গানটি ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞাপনচিত্রের জন্য গানটি আবার গাইলেন আজম খান।
রেললাইনের ওই বস্তিতে
১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ লাগল। তখন কমলাপুর থেকে নটরডেম কলেজের ফুটপাত মানুষে ভরপুর। মানুষ মারা যাচ্ছে। কবর দেওয়ার মানুষ নেই। মা তার দুধের সন্তানকে রেখে পালিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষুধার জ্বালায় বাচ্চাকে বিক্রিও করে দিচ্ছেন। তখন নতুন নতুন গান করতেন আজম খান। ফুটপাতের বাচ্চাগুলো তাকে দেখলে মামা মামা বলে ডাকত। একদিন দেখেন এক বাচ্চা কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলেন, 'কী হইছে?' একজন বলল, 'মা বাচ্চাটারে রাইখা পলাইছে।' সব শুনে বুকটা ফেটে গেল। মনে মনে তখনই গানের লাইন খুঁজে পেলেন। লিখলেন, 'রেললাইনের ওই বস্তিতে...'। তারপর গাইলেন। এ গান আজও শ্রোতাদের আলোড়িত করে।
ওরে সালেকা ওরে মালেকা
এটি পাকিস্তান আমলের গান। জসীম উদ্দীন রোডে ঢুকতেই চিটাগাং হোটেলের পাশে ছিল টাওয়ার হোটেল। সেটা একতলা থেকে দোতলা হয়েছে। সেখানে একটা পানির ট্যাঙ্ক ছিল। আজম খানের বল্পুব্দ নীলু গিটার বাজাতেন। ছোট বাঁশের স্টিক দিয়ে পানির ট্যাঙ্কটাকে তিনি ড্রাম বানিয়ে বাজাতে লাগলেন। সেই রিদমের তালে তালে তারা পাঁচ-ছয় বল্পুব্দ মজা করছেন। নীলুর বিটের তালে কোনো ছাড়াই পপসম্রাটের মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো, 'ওরে সালেকা ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে'। এ গান নিয়ে পরে দেড় ঘণ্টা মজা করলেন তারা। এরপর ১৯৭৩ সালে তারা যখন পপ গান করেন, তখন হঠাৎ মাথায় এলো এ গানটাও তো করা যা! তারপর গানটা নতুন করে গাইলেন আজম খান। সেটাও সুপারহিট।
অভিমানী তুমি কোথায়
১৯৭৩ সালে এটি লেখেন আজম খান। তিনি খাতা-কলমে কোনোদিন গান লিখতেন না। হঠাৎ মাথায় এসে পড়লে মুখে মুখেই বানিয়ে ফেলতেন। তারা আড্ডা দিতেন চিটাগাং হোটেলের সামনে। সঙ্গে একটা গিটার থাকত। যেখানে গান করতেন সেখানে এক ভারতীয় পাগল ছিল। সে সুরে সুরে একটা গান গাইত আর নাচত, 'ইতলের বিনা, বিনারে ভাগি, বিনা চালা গ্যায়া।' ঠাণ্ডা পাগল ছিল। শুনে খুব মজা লাগত। এই গান থেকে তিনি পেয়ে গেলেন সুর। হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, 'অভিমানী, তুমি কোথায় হারিয়ে গেছো ...'।