‘বাদল দিনের পাখি’র পর আর কোনো অ্যালবামে গাইবেন না বাংলাদেশের সংগীত ভূবনের উজ্জল নক্ষত্র শাহনাজ রহমতউল্লাহর।আর কোনো চলচ্চিত্রের গানেও তিনি কণ্ঠ দেবেন না। ৫০ বছরের সঙ্গীত জীবনে শাহনাজের চারটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম অ্যালবামটি ছিল প্রণব ঘোষের সুরে ‘বারোটি বছর পরে’। ১৯৬৩ সালে ‘নতুন সুর’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু করেছিলেন চিরসবুজ এ গায়িকা।
‘বাদল দিনের পাখি’ বাজারে এনেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সন্ধ্যাবৃষ্টি। ৩ সেপ্টেম্বর সোমবার অ্যালবামটি বাজারে ছাড়া হয়েছে। ডা. ইকবালের পরিকল্পনায় ‘বাদলদিনের পাখি’ অ্যালবামে গান রয়েছে ১৪টি। এর মধ্যে তিনটি গান গেয়েছেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। বাকি গানগুলো গেয়েছেন শাকিলা জাফর, ফাহমিদা নবী, আলম আরা মিনু, রূপম, যুবীন, তানজিনা, পঙ্কজ, নাজমুল, জাকিয়া সুলতানা ও ডা. ইকবাল।
অ্যালবামটি প্রসঙ্গে শাহনাজ রহমতউল্লাহ বলেন, ‘খুবই ভালো কথার গান করেছি; সুরও চমৎকার। ১৪টি গানের মধ্যে আমি তিনটি গানে কণ্ঠ দিয়েছি। আমার সবগুলো গানের সুর করেছেন ইকবাল। বেশ যত্ন নিয়ে তিনি গানগুলো তৈরি করেছেন। আশা করছি, অ্যালবামের সবগুলো গানই শ্রোতাদের ভালো লাগবে।’শেষ গান প্রসঙ্গে শাহনাজ রহমতউল্লাহ বলেন, ‘৫০ বছরের সংগীতজীবন আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আজকে আমার যে অবস্থান, তা সংগীতের কল্যাণেই হয়েছে। কোনো ধরনের অভিমানের কারণে গানের জগত্ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি না। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’
বিবিসি জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র গাওয়া চারটি গান স্হান পেয়েছে।তার গাওয়া বহু গান এখনও ব্যাপক জনপ্রিয়।
‘বাদল দিনের পাখি’ বাজারে এনেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সন্ধ্যাবৃষ্টি। ৩ সেপ্টেম্বর সোমবার অ্যালবামটি বাজারে ছাড়া হয়েছে। ডা. ইকবালের পরিকল্পনায় ‘বাদলদিনের পাখি’ অ্যালবামে গান রয়েছে ১৪টি। এর মধ্যে তিনটি গান গেয়েছেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। বাকি গানগুলো গেয়েছেন শাকিলা জাফর, ফাহমিদা নবী, আলম আরা মিনু, রূপম, যুবীন, তানজিনা, পঙ্কজ, নাজমুল, জাকিয়া সুলতানা ও ডা. ইকবাল।
অ্যালবামটি প্রসঙ্গে শাহনাজ রহমতউল্লাহ বলেন, ‘খুবই ভালো কথার গান করেছি; সুরও চমৎকার। ১৪টি গানের মধ্যে আমি তিনটি গানে কণ্ঠ দিয়েছি। আমার সবগুলো গানের সুর করেছেন ইকবাল। বেশ যত্ন নিয়ে তিনি গানগুলো তৈরি করেছেন। আশা করছি, অ্যালবামের সবগুলো গানই শ্রোতাদের ভালো লাগবে।’শেষ গান প্রসঙ্গে শাহনাজ রহমতউল্লাহ বলেন, ‘৫০ বছরের সংগীতজীবন আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আজকে আমার যে অবস্থান, তা সংগীতের কল্যাণেই হয়েছে। কোনো ধরনের অভিমানের কারণে গানের জগত্ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি না। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’
বিবিসি জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র গাওয়া চারটি গান স্হান পেয়েছে।তার গাওয়া বহু গান এখনও ব্যাপক জনপ্রিয়।
আর গান গাইবেন না শাহনাজ রহমতুল্লাহ
ঘোষণা দিয়ে ইতি টানলেন অর্ধযুগের বর্ণাঢ্য সংগীত যাত্রার। জীবনের পড়ন্তবেলায় শুরু করেছেন অন্য এক যাত্রা। এক সকালে সেই যাত্রার গল্প শুনলেন শাকিল ফারুক। ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান
ধদরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিজেই। শহুরে সকাল ফুরোয়নি এখনো। কিন্তু শাহনাজ রহমতুল্লাহর চোখেমুখে ব্যস্ততা ভীষণ। শুভেচ্ছা-সম্ভাষণ পর্বে গেলেন না, শুরুতেই তাড়া দিলেন, 'এটাই শেষ সাক্ষাৎকার। আর কোনো সাক্ষাৎকার দেব না কাউকে। আপনাকেই দিচ্ছি শেষ সাক্ষাৎকারটা। একটু তাড়াতাড়ি করে ফেলুন তো।'
আজ (সোমবার) সম্ভবত শাহনাজ রহমতুল্লাহর সাক্ষাৎকার দিবস। মাত্র-ই একদল বিদায় নিল, সাক্ষাৎকার নিয়ে। কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পী ঘোষণা দিয়েছেন, গান গাইবেন না আর। অমনি হৈচৈ। ঘটনা কী? শাহনাজ রহমতুল্লাহ সাক্ষাৎকার-ছবি তোলার মতো বিষয়গুলোতে বরাবরই খুব মেজাজি। তবে এবার ঘটনা জানতে উৎসুকদের বিমুখ করেননি। আমরাও সেই দলে। প্রথমেই তাই জানতে চাই, গান ছাড়ছেন কেন?
শাহনাজ রহমতুল্লাহর বয়স এখন ষাটের ঘাটে। কিন্তু কণ্ঠে বয়সের ভার নেই। প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট গলায় ফটাফট জবাব, '৫০ বছর কাটিয়েছি গানে গানে। এখন সময় কাটাব সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য পালনে। আমারও তো ধর্মীয় মূল্যবোধ আছে, তাই না? সৃষ্টিকর্তার এবাদতও সাধনা।' ধর্মীয় বিশ্বাসে নিজের ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার অনুভূতি অকপটে বয়ান করলেন।
আর আমাদের চোখে বিমূর্ত হয়ে উঠল অন্য এক শাহনাজ রহমতুল্লাহর ছবি। মূর্ত শাহনাজ রহমতুল্লাহর বয়ানে পাওয়া গেল, চেনা কিংবদন্তির অচেনা পৃথিবীর খোঁজ। শাহনাজ রহমতুল্লাহর এই পৃথিবীর সব আয়োজন একজনকে ঘিরে। সেই একজন- মেজর আবুল বাশার রহমতুল্লাহ। শাহনাজ রহমতুল্লাহর স্বামী। সাবেক সেনা কর্মকর্তা, বর্তমানে ব্যবসায়ী। এ মানুষটার সঙ্গে কাটিয়েছেন দাম্পত্য জীবনের ৪০টি বছর। বাশার সাহেব ধার্মিক মানুষ। ধর্ম-কর্মে বহু আগে থেকেই একনিষ্ঠ, কিন্তু স্ত্রীর সুরের পথচলায় বাঁধ সাধেননি কখনো। বরং স্ত্রীকে দিয়েছেন অনেক স্বাধীনতা। সাহায্য করেছেন পরম ভালোবাসায়। 'এই মানুষটার কাছে আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। তাঁর পাশপাশেই থাকতে চাই এখন পুরোটা সময়। আমার স্বামী ধার্মিক মানুষ। তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি প্রেরণা। দুজন মিলে এখন ধর্ম-কর্ম নিয়েই বেশ আছি, শান্তিতে আছি।'- বলছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। জীবনের বাকি সময়টুকু নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে এভাবেই ভালো থাকবেন বলে ঠিক করেছেন তাঁরা।
শুধু নিজেরা ভালো থাকছেন না, রাখছেনও! দুর্গতদের সেবায় রহমতুল্লাহ দম্পতির প্রাণান্ত চেষ্টা। তাঁদের বাড়ির নিচে প্রায় প্রতিদিনই ভিড় জমে অভাবি মানুষের। আবুল বাশার উদার হাতে বিলিয়ে থাকেন অর্থ সাহায্য। আর শাহনাজ রহমতুল্লাহ নিরন্ন-ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে তুলে দেন খাবার। 'প্রতি শুক্রবার আয়োজন হয়। ৭০ থেকে ৮০ জন খেয়ে যায়। আমার স্বামী বলেন, তারা আমাদের মেহমান। তাদের খেদমতে খুঁত রাখা যাবে না। নিজ হাতে রান্না করি সবার জন্য, তদারকি করে খাওয়াই'- বললেন শাহনাজ।
পাঁচতলা বাড়িটির ছাদে বাগান আছে একটা। মালী আছে, কিন্তু দেখাশোনা করেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ নিজেই। কিছু পাখপাখালিও পালন করেন। নামাজ তো কোনো ওয়াক্ত বাদ যায়ইনি, বরং সব ধর্মীয় অনুশাসন কঠোরভাবে অনুসরণের চেষ্টা করেন খুব। চিকিৎসকের সঙ্গেও রাখতে হয় নিয়মিত যোগাযোগ, বয়স হয়েছে না! এমন কতশত সম্পৃক্ততা! ছেলেমেয়েরা বিদেশে, কাজের লোকে বাড়িভর্তি। স্বামীকে নিয়ে শাহনাজ রহমতুল্লাহর 'দোকলা' সংসারে তবু রাজ্যের ব্যস্ততা। গানটাকে তাই তুলে রাখলেন স্মৃতির আলনায়। শাহনাজ রহমতুল্লাহর পৃথিবী এখন সংগীতহীন প্রায়, 'গত দুই-তিন বছর রেওয়াজও করিনি। কয়েকটা কনসার্ট করেছি দেশের বাইরে। এ ছাড়া আর কিছুতেই জড়াইনি। তবে হুট করে সরে গেছি বলা যাবে না, বিয়ের পর থেকেই কিন্তু আমি সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বেশি। বিয়ের পর হাতেগোনা প্লেব্যাক করেছি। এখন সেসব সীমিত ব্যস্ততা থেকেও ছুটি নিয়ে নিলাম।' এভাবেই সমাপ্তি ঘটে গেল পাঁচ দশকের দীর্ঘ এক সুরেলা যাত্রার। এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র পাঁচটি একক অ্যালবাম! টেলিভিশন, রেডিও আর চলচ্চিত্রে কত কালজয়ী গান তাঁর কণ্ঠে হৃদয় ছোঁয়া হয়ে উঠেছে। বিবিসি জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকার চারটিই শাহনাজ রহমতুল্লাহর। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক একুশে পুরস্কারসহ পেয়েছেন অজস্র স্বীকৃতি। বলতে গিয়ে চোখে ভাসে পুরনো পট কোনো। শাহনাজ বলেন, 'বিদেশে গিয়ে গাইছি, একবার যেতে দে না, আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়। গান শুনে লোকে কেঁদেছে। নাড়ির টান জাগছে মনে। এসব কজন শিল্পীর ভাগ্যে জোটে! পথেঘাটে নানা বয়সের মানুষ আজও জানায়, আমার এই গান-ওই গান তাদের প্রিয়। গান গাইব না শুনে কত ভক্তের ফোন! অনুরোধ-অনুযোগ। মানুষের ভালোবাসা- এই ভালোবাসার চেয়ে বড় পাওয়া আছে কিছু! সবার কাছে দোয়া চাই, শুভ কামনা চাই। গাইতে গাইতে বিদায় নিচ্ছি, এটাও কম কী! এবার স্বামীর পাশে বাকিটা জীবন কাটুক আমার।' সব কথায় ঘুরে ফিরে আসছে শাহনাজ রহমতুল্লাহর স্বামীর কথা। এই সংগীত মহাতারকার স্বামীভক্তির উচ্চতা বুঝতে তাঁর একটা কথাই যথেষ্ট- 'আমার স্বামী বলেন, আমার স্ত্রীর গাওয়া দুঃখের গান শুনলে চোখে পানি চলে আসে। তাঁর এই কথাটাই আমার ৫০ বছরের সংগীত জীবনের বড় পাওয়া।' বলছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ।
বাকি রইল কিছু? কোনো চাওয়া? স্বপ্ন? শাহনাজ রহমতুল্লাহ ভাবলেন কিছু সময়। আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় সেই মুহূর্তগুলো আটকে রইল। বললেন, আরেকজন শাহনাজ রহমতুল্লাহ দেখে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। নতুনদের গান এখন আর নিয়মিত শোনা হয় না। তবে কানে আসে কিছু কিছু সুর। ভালো লাগে কাকে? 'হুট করে কি আর বলা যায়? সারগাম বশে আনতেই ফুরিয়ে যায় ১৫-২০ বছর। গান আসে ভেতর থেকে। প্রক্রিয়াটা যখন ঠিক হয়, তখন সব গানই কণ্ঠে চলে আসবে।' এই মুহূর্তে ঘটে গেল কিছু বিরল ঘটনা। কিন্নর কণ্ঠে নিজের বিখ্যাত কয়েকটি গানের অংশ বিশেষ একের গেয়ে শোনালেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। এ তো আর সচরাচর ঘটনা নয়। গান থামিয়ে এবার বললেন, 'আমি পণ্ডিত নই। উপদেশ দেব না। তবে নতুনদের কিছু কিছু গান শুনেছি টিভি অনুষ্ঠানে। কণ্ঠগুলো কেমন হাসকি ধরনের, গানের কথা-সুরের গভীরতা কমে যাচ্ছে। অন্তরঙ্গতা চাই আরো। শ্রদ্ধা থাকতে হবে। ভুল গেও না।' পর প্রজন্মের একজন পছন্দের শিল্পীর নামই বলতে পারলেন অতীত ঘেঁটে- সামিনা চৌধুরী।
কথার ফাঁকেও বৈঠকঘর লাগোয়া একটা কাচের দরজায় সজাগ দৃষ্টি রাখছেন বারবার। বিষয় কী? শাহনাজ রহমতুল্লাহ নিজেই কৌতূহল মেটান আমাদের, দরজায় ওপাশের ঘরে ঘুমিয়ে আছেন আবুল বাশার। কিছুক্ষণ পরেই তাঁর ঘুম ভাঙানোর নির্ধারিত সময়। স্বামীর ঘুম ভাঙানো থেকে শুরু করে নাওয়া-খাওয়া, প্রত্যেক বিষয় খুব সতর্কভাবে সামলান শাহনাজ নিজ হাতে। একটুও যেন এদিক-সেদিক না হয়। সাক্ষাৎকারের মধ্যেও তাই সঠিক সময়ের অপেক্ষায় তিনি। এই অপেক্ষার মাধুর্য বড় আনন্দের। যার টানে ৪০ বছর পাড়ি দিয়েও দুজনের ভালোবাসার গভীরতা কমেনি।
জানালা গলে গ্রিলের নকশাকাটা রোদ তখন বৈঠকখানার মেঝেতে। আলোকচিত্রীর সঙ্গে কিছু একটা কথায় প্রাণ খুলে হাসছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। রোদে-হাসিতে ঝলমল করছে চারপাশ। হাসির টুকরো মুখে, একেবারে লিফট পর্যন্ত এলেন বিদায় জানাতে। উজ্জ্বল-প্রাণবন্ত এই হাসিমুখ দেখা যাবে না আর গানের মঞ্চে। কিন্তু বাংলা গানের আকাশে তিনি নক্ষত্র হয়ে থাকবেন অনন্তকাল, কালজয়ী সব গানের সুরে, কথায়।
তথ্যসূত্রঃ কালের কণ্ঠ
ধদরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিজেই। শহুরে সকাল ফুরোয়নি এখনো। কিন্তু শাহনাজ রহমতুল্লাহর চোখেমুখে ব্যস্ততা ভীষণ। শুভেচ্ছা-সম্ভাষণ পর্বে গেলেন না, শুরুতেই তাড়া দিলেন, 'এটাই শেষ সাক্ষাৎকার। আর কোনো সাক্ষাৎকার দেব না কাউকে। আপনাকেই দিচ্ছি শেষ সাক্ষাৎকারটা। একটু তাড়াতাড়ি করে ফেলুন তো।'
আজ (সোমবার) সম্ভবত শাহনাজ রহমতুল্লাহর সাক্ষাৎকার দিবস। মাত্র-ই একদল বিদায় নিল, সাক্ষাৎকার নিয়ে। কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পী ঘোষণা দিয়েছেন, গান গাইবেন না আর। অমনি হৈচৈ। ঘটনা কী? শাহনাজ রহমতুল্লাহ সাক্ষাৎকার-ছবি তোলার মতো বিষয়গুলোতে বরাবরই খুব মেজাজি। তবে এবার ঘটনা জানতে উৎসুকদের বিমুখ করেননি। আমরাও সেই দলে। প্রথমেই তাই জানতে চাই, গান ছাড়ছেন কেন?
শাহনাজ রহমতুল্লাহর বয়স এখন ষাটের ঘাটে। কিন্তু কণ্ঠে বয়সের ভার নেই। প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট গলায় ফটাফট জবাব, '৫০ বছর কাটিয়েছি গানে গানে। এখন সময় কাটাব সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য পালনে। আমারও তো ধর্মীয় মূল্যবোধ আছে, তাই না? সৃষ্টিকর্তার এবাদতও সাধনা।' ধর্মীয় বিশ্বাসে নিজের ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার অনুভূতি অকপটে বয়ান করলেন।
আর আমাদের চোখে বিমূর্ত হয়ে উঠল অন্য এক শাহনাজ রহমতুল্লাহর ছবি। মূর্ত শাহনাজ রহমতুল্লাহর বয়ানে পাওয়া গেল, চেনা কিংবদন্তির অচেনা পৃথিবীর খোঁজ। শাহনাজ রহমতুল্লাহর এই পৃথিবীর সব আয়োজন একজনকে ঘিরে। সেই একজন- মেজর আবুল বাশার রহমতুল্লাহ। শাহনাজ রহমতুল্লাহর স্বামী। সাবেক সেনা কর্মকর্তা, বর্তমানে ব্যবসায়ী। এ মানুষটার সঙ্গে কাটিয়েছেন দাম্পত্য জীবনের ৪০টি বছর। বাশার সাহেব ধার্মিক মানুষ। ধর্ম-কর্মে বহু আগে থেকেই একনিষ্ঠ, কিন্তু স্ত্রীর সুরের পথচলায় বাঁধ সাধেননি কখনো। বরং স্ত্রীকে দিয়েছেন অনেক স্বাধীনতা। সাহায্য করেছেন পরম ভালোবাসায়। 'এই মানুষটার কাছে আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। তাঁর পাশপাশেই থাকতে চাই এখন পুরোটা সময়। আমার স্বামী ধার্মিক মানুষ। তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি প্রেরণা। দুজন মিলে এখন ধর্ম-কর্ম নিয়েই বেশ আছি, শান্তিতে আছি।'- বলছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। জীবনের বাকি সময়টুকু নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে এভাবেই ভালো থাকবেন বলে ঠিক করেছেন তাঁরা।
শুধু নিজেরা ভালো থাকছেন না, রাখছেনও! দুর্গতদের সেবায় রহমতুল্লাহ দম্পতির প্রাণান্ত চেষ্টা। তাঁদের বাড়ির নিচে প্রায় প্রতিদিনই ভিড় জমে অভাবি মানুষের। আবুল বাশার উদার হাতে বিলিয়ে থাকেন অর্থ সাহায্য। আর শাহনাজ রহমতুল্লাহ নিরন্ন-ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে তুলে দেন খাবার। 'প্রতি শুক্রবার আয়োজন হয়। ৭০ থেকে ৮০ জন খেয়ে যায়। আমার স্বামী বলেন, তারা আমাদের মেহমান। তাদের খেদমতে খুঁত রাখা যাবে না। নিজ হাতে রান্না করি সবার জন্য, তদারকি করে খাওয়াই'- বললেন শাহনাজ।
পাঁচতলা বাড়িটির ছাদে বাগান আছে একটা। মালী আছে, কিন্তু দেখাশোনা করেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ নিজেই। কিছু পাখপাখালিও পালন করেন। নামাজ তো কোনো ওয়াক্ত বাদ যায়ইনি, বরং সব ধর্মীয় অনুশাসন কঠোরভাবে অনুসরণের চেষ্টা করেন খুব। চিকিৎসকের সঙ্গেও রাখতে হয় নিয়মিত যোগাযোগ, বয়স হয়েছে না! এমন কতশত সম্পৃক্ততা! ছেলেমেয়েরা বিদেশে, কাজের লোকে বাড়িভর্তি। স্বামীকে নিয়ে শাহনাজ রহমতুল্লাহর 'দোকলা' সংসারে তবু রাজ্যের ব্যস্ততা। গানটাকে তাই তুলে রাখলেন স্মৃতির আলনায়। শাহনাজ রহমতুল্লাহর পৃথিবী এখন সংগীতহীন প্রায়, 'গত দুই-তিন বছর রেওয়াজও করিনি। কয়েকটা কনসার্ট করেছি দেশের বাইরে। এ ছাড়া আর কিছুতেই জড়াইনি। তবে হুট করে সরে গেছি বলা যাবে না, বিয়ের পর থেকেই কিন্তু আমি সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বেশি। বিয়ের পর হাতেগোনা প্লেব্যাক করেছি। এখন সেসব সীমিত ব্যস্ততা থেকেও ছুটি নিয়ে নিলাম।' এভাবেই সমাপ্তি ঘটে গেল পাঁচ দশকের দীর্ঘ এক সুরেলা যাত্রার। এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র পাঁচটি একক অ্যালবাম! টেলিভিশন, রেডিও আর চলচ্চিত্রে কত কালজয়ী গান তাঁর কণ্ঠে হৃদয় ছোঁয়া হয়ে উঠেছে। বিবিসি জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকার চারটিই শাহনাজ রহমতুল্লাহর। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক একুশে পুরস্কারসহ পেয়েছেন অজস্র স্বীকৃতি। বলতে গিয়ে চোখে ভাসে পুরনো পট কোনো। শাহনাজ বলেন, 'বিদেশে গিয়ে গাইছি, একবার যেতে দে না, আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়। গান শুনে লোকে কেঁদেছে। নাড়ির টান জাগছে মনে। এসব কজন শিল্পীর ভাগ্যে জোটে! পথেঘাটে নানা বয়সের মানুষ আজও জানায়, আমার এই গান-ওই গান তাদের প্রিয়। গান গাইব না শুনে কত ভক্তের ফোন! অনুরোধ-অনুযোগ। মানুষের ভালোবাসা- এই ভালোবাসার চেয়ে বড় পাওয়া আছে কিছু! সবার কাছে দোয়া চাই, শুভ কামনা চাই। গাইতে গাইতে বিদায় নিচ্ছি, এটাও কম কী! এবার স্বামীর পাশে বাকিটা জীবন কাটুক আমার।' সব কথায় ঘুরে ফিরে আসছে শাহনাজ রহমতুল্লাহর স্বামীর কথা। এই সংগীত মহাতারকার স্বামীভক্তির উচ্চতা বুঝতে তাঁর একটা কথাই যথেষ্ট- 'আমার স্বামী বলেন, আমার স্ত্রীর গাওয়া দুঃখের গান শুনলে চোখে পানি চলে আসে। তাঁর এই কথাটাই আমার ৫০ বছরের সংগীত জীবনের বড় পাওয়া।' বলছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ।
বাকি রইল কিছু? কোনো চাওয়া? স্বপ্ন? শাহনাজ রহমতুল্লাহ ভাবলেন কিছু সময়। আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় সেই মুহূর্তগুলো আটকে রইল। বললেন, আরেকজন শাহনাজ রহমতুল্লাহ দেখে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। নতুনদের গান এখন আর নিয়মিত শোনা হয় না। তবে কানে আসে কিছু কিছু সুর। ভালো লাগে কাকে? 'হুট করে কি আর বলা যায়? সারগাম বশে আনতেই ফুরিয়ে যায় ১৫-২০ বছর। গান আসে ভেতর থেকে। প্রক্রিয়াটা যখন ঠিক হয়, তখন সব গানই কণ্ঠে চলে আসবে।' এই মুহূর্তে ঘটে গেল কিছু বিরল ঘটনা। কিন্নর কণ্ঠে নিজের বিখ্যাত কয়েকটি গানের অংশ বিশেষ একের গেয়ে শোনালেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। এ তো আর সচরাচর ঘটনা নয়। গান থামিয়ে এবার বললেন, 'আমি পণ্ডিত নই। উপদেশ দেব না। তবে নতুনদের কিছু কিছু গান শুনেছি টিভি অনুষ্ঠানে। কণ্ঠগুলো কেমন হাসকি ধরনের, গানের কথা-সুরের গভীরতা কমে যাচ্ছে। অন্তরঙ্গতা চাই আরো। শ্রদ্ধা থাকতে হবে। ভুল গেও না।' পর প্রজন্মের একজন পছন্দের শিল্পীর নামই বলতে পারলেন অতীত ঘেঁটে- সামিনা চৌধুরী।
কথার ফাঁকেও বৈঠকঘর লাগোয়া একটা কাচের দরজায় সজাগ দৃষ্টি রাখছেন বারবার। বিষয় কী? শাহনাজ রহমতুল্লাহ নিজেই কৌতূহল মেটান আমাদের, দরজায় ওপাশের ঘরে ঘুমিয়ে আছেন আবুল বাশার। কিছুক্ষণ পরেই তাঁর ঘুম ভাঙানোর নির্ধারিত সময়। স্বামীর ঘুম ভাঙানো থেকে শুরু করে নাওয়া-খাওয়া, প্রত্যেক বিষয় খুব সতর্কভাবে সামলান শাহনাজ নিজ হাতে। একটুও যেন এদিক-সেদিক না হয়। সাক্ষাৎকারের মধ্যেও তাই সঠিক সময়ের অপেক্ষায় তিনি। এই অপেক্ষার মাধুর্য বড় আনন্দের। যার টানে ৪০ বছর পাড়ি দিয়েও দুজনের ভালোবাসার গভীরতা কমেনি।
জানালা গলে গ্রিলের নকশাকাটা রোদ তখন বৈঠকখানার মেঝেতে। আলোকচিত্রীর সঙ্গে কিছু একটা কথায় প্রাণ খুলে হাসছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। রোদে-হাসিতে ঝলমল করছে চারপাশ। হাসির টুকরো মুখে, একেবারে লিফট পর্যন্ত এলেন বিদায় জানাতে। উজ্জ্বল-প্রাণবন্ত এই হাসিমুখ দেখা যাবে না আর গানের মঞ্চে। কিন্তু বাংলা গানের আকাশে তিনি নক্ষত্র হয়ে থাকবেন অনন্তকাল, কালজয়ী সব গানের সুরে, কথায়।
তথ্যসূত্রঃ কালের কণ্ঠ