সাবিনা ইয়াসমিন’ এর দেশের গান
দেশাত্ববোধক গানের ক্ষেত্রে সাবিনা ইয়াসমিন বলা যায় – অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫-৪০টি দেশের গান গেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গান তৈরির নেপথ্যের কথা জানাচ্ছেন শিল্পী নিজে ও গানের সুরকার।
জন্ম আমার ধন্য হলো
|
খুবই হৃদয়ছোঁয়া একটি গান। করাচির ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের জন্য ১৯৭০ সালে এই গানটি করাচির একটি স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয়েছিল। গানটি লিখেছেন নঈম গওহর। সুর করেছেন আজাদ রহমান। গানটি সাবিনা রেকর্ড করেন নজরুলসংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে। ওই সময় এইচএমভি থেকে দুটো গানের একটি রেকর্ড বের হয়। যেখানে প্রথম গানটি ছিল সমবেত কণ্ঠে গাওয়া “পূবের ওই আকাশে সূর্য উঠেছে আলোকে আলোকময়”। তার সঙ্গে “জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো” গানটি সংযোজিত হয়। এই গান পরবর্তী সময়ে কাজী হায়াতের ‘দেশপ্রেমিক’ ছবিতে ব্যবহার করা হয় সাবিনার কণ্ঠে।
আজাদ রহমান বলেন ‘করাচির ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে এই গানটি রেকর্ড করি। এ গানে ফিরোজা বেগমের সঙ্গে সাবিনা তো ছিলই, আরও বেশ কজন সহশিল্পীও এ গানের কোরাসে অংশ নিয়েছিলেন। এ মুহূর্তে জিনাত রেহানা, নাসির হায়দার, আহমেদুল্লাহ সিদ্দিকী, আসাদুল হক, লায়লা মোজাম্মেলের নাম মনে পড়ছে। |
জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো,
এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাক।। তোমার কথায় হাসতে পারি, তোমার কথায় কাঁদতে পারি, মরতে পারি তোমার বুকে বুকে যদি রাখো আমায়- বুকে যদি রাখো মাগো।। তোমার কথায় কথা বলি পাখীর গানের মত, তোমার দেখায় বিশ্ব দেখি বর্ণ কত শত, তুমি আমার, তুমি আমার খেলার পুতুল, আমার পাশে থাকো মাগো। তোমার প্রেমে তোমার গন্ধে পরান ভরে রাখি এই তো আমার জীবন মরণ এমনি যেন থাকি বুকে তোমার, বুকে তোমার ঘুমিয়ে গেলে জাগিয়ে দিও নাকো আমায় জাগিয়ে দিও নাকো মাগো।। |
ও আমার বাংলা মা তোর
|
ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায়
হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে, ও আমার বাংলা মাগো।। ফাগুনে তোর কৃষ্ণচুড়া পলাশ বনে কিসের হাসি চৈতী রাতে উদাস সুরে রাখাল বাজায় বাঁশের বাঁশী।। বোশেখে তোর রুদ্র ভয়াল, কেতন উড়ায় কাল বোশেখী জোষ্ঠি মাসে বনে বনে আম কাঁঠালের হাট বসে কি।। শ্যামল মেঘের ভেলায় চড়ে, আষাঢ় নামে তোমার বুকে শ্রাবন ধারায় বরষাতে কি স্নান করিস পরম সুখে।। নীলাম্বরী শাড়ী পড়ে, শরৎ আসে ভাদর মাসে অঘ্রানে তোর ধানের ক্ষেতে সোনা রঙে ফসল হাসে।। নিত্য চাষীর কুঁড়ে ঘরে, দিস মাগো তুই আঁচল ভরে পৌষ পাবনের ননান্ন ধান আপন হাতে উজার করে।। |
আলাউদ্দিন আলীর সুর করা। গানটির কথা লিখেছেন আবুল ওমরাও মো. ফখরুদ্দিন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দীর্ঘ সময় নিয়ে গানটি লিখেছিলেন তিনি। এ গানটি ১৯৭২ সালে করা। প্রথম গানটি রেকর্ড করা হয় ডিআইটি টিভি ভবনে। মূলত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটা চলচ্চিত্র ‘এক ঝাঁক বলাকা’ জন্য গানটি সাবিনা গেয়েছিলাম।
সংগীত পরিচালক হিসেবে আলাউদ্দিন আলীর এটি প্রথম ছবি ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিটি হয়নি। পরে দ্বিতীয় দফায় গানটি আবার রেকর্ড করা হয় বিটিভির জন্য। |
একটি বাংলাদেশ তুমি
|
গানটি অসম্ভব শ্রোতাপ্রিয় একটি গান। এই গানটি ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের জন্য করা। সম্ভবত ১৯৭৪-৭৫ সালে। গানটি সুর করেছেন অজিত রায়, আর লিখেছেন প্রয়াত নজরুল ইসলাম বাবু। যিনি সাবিনার গাওয়া আরও কিছু দেশের গান লিখেছিলেন।
এই গানটি প্রথম রেডিওর জন্য করলেও অনেক বছর পর বিটিভির জন্য নতুন করে রেকর্ড করা হয়। |
একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার
সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার। তোমার স্বাধীনতা গৌরব সৌরভে এনেছে আমার প্রানের সূর্যে রৌদ্রেরও সজীবতা দিয়েছে সোনালী সুখী জীবনের দৃপ্ত অঙ্গীকার। সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার। তোমার ছায়া ঢাকা রৌদ্রেরেরও প্রান্তরে রেখেছি অতল অমর বর্নে মুক্তির স্নেহ মাখা জেনেছি তুমি জীবন মরণে বিমুগ্ধ চেতনার। সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার। |
ও মাঝি নাও ছাইড়া দে
|
ও মাঝি নাও ছাইরা দে
ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে গা-রে মাঝি গা কোন গান।। একদিন তোর নাও মাঝি ভাসবে না রে নীল নদীতে রে সেদিন তোর গান মাঝি শুনবে না কেউ গাইবে না বলে- ও মাঝি রে, ও কলের নৌকা কাইরা নিবে সুর।। যন্ত্রের নাও ধোঁয়া ছাইরা আঁধার করল নীল আকাশটারে, ও মাঝি রে- সেদিন তোর নাও মাঝি শূণ্য হয়ে থাকবে রে পরে- ও মাঝি রে- ও চল রে মাঝি যাইরে বহু দূর।। |
সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গানটি লিখেছিলেন প্রয়াত এস এম হেদায়েত। গানটি সাবিনার কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয়। কারণ যখন গানটি রেকর্ড করা হয় তখন শ্রাবণ (সাবিনার ছেলে) তার গর্ভে ছিলেন।দু-এক মাসের মধ্যেই আমার ডেলিভারি। এ গানটি লিখেছিলেন প্রয়াত এস এম হেদায়েত। তবে এ গানগুলোর প্রেক্ষাপট বেশি ভালো বলতে পারবেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।’
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বলেন সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া দেশের গানগুলোর প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘একসময় আমি টানা আট বছর শুধু দেশের গানই করেছি, অন্য কোনো গান নয়।’ |
সব ক’টা জানালা খুলে দাও না
|
সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গানটি লিখেছেন প্রয়াত নজরুল ইসলাম বাবু। গানটি করা হয়েছিল ১৯৮২ সালের দিকে ২৬ মার্চ বিটিভির বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য। ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল। রেকর্ডিস্ট ছিলেন শাফায়াত আলী খান। গিটার বাজিয়েছিল টিপু এবং প্রয়াত শেখ ইশতিয়াক। তবলায় দেবু ভট্টাচার্য। পারকেশনে ইমতিয়াজ। আর ভায়াব্রোফোন বাজিয়েছিল মানাম আহমেদ। সুরকার কি-বোর্ড আর বেজ গিটার বাজিয়েছিলেন। গানটি টানা আট-নয় বছর বিটিভির খবরের আগে ও পরে বাজানো হয়েছে। |
সব ক’টা জানালা খুলে দাও না
আমি গাইব গাইব বিজয়েরই গান ওরা আসবে চুপি চুপি… যারা এই দেশ টাকে ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।। চোখ থেকে মুছে ফেল অশ্রুটুকু এমন খুশির দিনে কাদঁতে নেই।। হারানো স্মৃতির বেদনাতে একাকার করে মন রাখতে নেই ওরা আসবে চুপি চুপি… কেউ যেন ভুল করে গেয়নাকো মন ভাঙ্গা গান সব ক’টা জানালা খুলে দাও না আজ আমি সারা নিশি থাকব জেগে ঘরের আলো সব আধাঁর করে ।। ছড়িয়ে রাখ আতর গোলাপ এদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে ওরা আসবে চুপি চুপি… কেউ যেন ভুল করে গেয়নাকো মন ভাঙ্গা গান সব ক’টা জানালা খুলে দাও না.. |
সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবন্য
|
সুন্দর সুবর্ণ তারুন্য লাবন্য
অপূর্ব রূপসী রূপেতে অনন্য।। আমার দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ও দেশ তোমারই জন্য।। থাকবে নাতো দুঃখ দারিদ্র বিভেদ-বেদনা-ক্রন্দন।। প্রতিটি ঘরে একই প্রশান্তি একই সুখের স্পন্দন।। তোমার জন্য হবো দুরন্ত তোমার জন্য শান্ত প্রহরী হয়ে দেব পাহারা যেথায় তোমার সীমান্ত।। |
গানটি লেখা এবং সুরও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের। ‘আমি দেশটাকে এই রূপে দেখতে ভালোবাসি'। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। চোখের সামনে আমার সহযোদ্ধা অনেকের মৃত্যু আমি দেখেছি। এ গানের একটা লাইন আছে “প্রহরী হয়ে দেব পাহারা যেথায় তোমার সীমান্ত”। এ লাইনটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৩ সালে বিটিভির বিজয় দিবস অনুষ্ঠানের জন্য গানটি করেছিলাম।’ জানান বুলবুল। |
সেই রেল লাইনের ধারে
|
যুদ্ধের পর এমন অনেক মাকে দেখা গেছে দিনের পর দিন সন্তানের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে। সেই ভাব থেকেই মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান গানটা লিখেছেন। সুর করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সম্ভবত ১৯৮৫ সালে বিটিভির বিশেষ সংগীতানুষ্ঠানের জন্য গানটি তৈরি করা হয়। |
সেই রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাড়িয়ে
এক মধ্যবয়সী নারী এখনো রয়েছে হাত বাড়িয়ে খোকা ফিরবে,ঘরে ফিরবে কবে ফিরবে,নাকি ফিরবে না ।। দৃষ্টি থেকে তার বৃষ্টি গেছে কবে শুকিয়ে সে তো অশ্রু মুছেনা আর গোপনে আঁচলে মুখ লুকিয়ে শুধু শূণ্যে চেয়ে থাকে যেন আকাশের সীমা ছাড়িয়ে খোকা ফিরবে,ঘরে ফিরবে কবে ফিরবে,নাকি ফিরবে না ।। দস্যি ছেলে সেই যুদ্ধে গেল ফিরলো না আর আজো শূণ্য হৃদয়ে তার গুমড়ে গুমড়ে যায় হাহাকার খোকা আসবে,ঘরে আসবে যেন মরণের সীমা ছাড়িয়ে খোকা ফিরবে,ঘরে ফিরবে কবে ফিরবে,নাকি ফিরবে না ।। |
গানটি লিখেছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। বুলবুল জানান- ‘একদিন গাজী ভাইকে বললাম, আমাকে কিছু দেশের গান লিখে দিন। তিনি বললেন, তুমি নিজেই তো ভালো গান লেখো। ঠিক আছে, আমি লিখে দেব, কিন্তু আমাকে একটু সময় দিতে হবে। এরপর এ গানটা পাই।’ |
মাগো আর তোমাকে
|
একতারা লাগেনা আমার
|
সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল জানান- ‘গানটি লিখেছেন মনিরুজ্জামান মনির। এ গানটিও আশির দশকের কোনো একসময় বিটিভির জন্য করা। ওই সময় আরও কিছু গান করি।’ |
১৯৭৫-৭৬ সালে বাংলাদেশ বেতারে গাওয়া হয় গানটি। এটি মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখা। সুর করেছেন খন্দকার নূরুল আলম। |
যদি মরণের পরে কেউ প্রশ্ন করে
|
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের লেখা ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম’, ‘আয় রে মা আয় রে’, ‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’, প্রয়াত নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ‘ও আমার আট কোটি ফুল’, ‘এই দেশটা আমার স্বপ্নে বোনা’, ‘যুদ্ধ এখনো থামেনি’, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘আমার বাজান গেল কই’ গানগুলি দেশের গান হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। গানগুলির প্রতিটার সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
এ ছাড়া ১৯৮০-৮১ সালের দিকে বিটিভির স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমানের কথা এবং আলাউদ্দিন আলীর সুরে সাবিনা ইয়াসমীন মোট আটটি গান গেয়েছিলেন।
এ ছাড়া ১৯৮০-৮১ সালের দিকে বিটিভির স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমানের কথা এবং আলাউদ্দিন আলীর সুরে সাবিনা ইয়াসমীন মোট আটটি গান গেয়েছিলেন।