সমকালীন গানের গল্প
‘মেয়ে তুমি এখনো আমায় বন্ধু ভাবো কি’ শিরোনামের এই গানটি আমি লিখেছিলাম ২০০৩ এর দিকে। তখন আমি সবেমাত্র নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। অনেক ছেলের সাথে নতুন করে বন্ধুত্ব হচ্ছে। সেই সাথে মেয়ে বন্ধুর সংখ্যাও বাড়ছে। এখানে মজার বিষয় হলো, আমি যেহেতু বরিশাল ক্যাডেট কলেজেই শিক্ষা জীবনের একটি বড় অংশ কাটিয়েছে তাই সে অর্থে আমার কোনো মেয়ে বন্ধু ছিল না। ফলে নর্থ সাউথ এ ভর্তি হয়ে যখন দেখলাম যে এখানে ছেলে-মেয়েদের বন্ধুত্ব এবং সেই বন্ধুত্ব থেকে কারো কারো প্রেমও হয়ে যাচ্ছে তখন বিষয়টা আমাকে বেশ নতুন একটা বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এ সময় অনেককেই দেখতাম যে তারা হয়তো প্রথমে বন্ধু হিসেবে সবার সাথে ঘুরছে। তারপর বন্ধু থাকতে থাকতেই একদিন একজন আরেকজনের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। কেউ হয়তো সফল হচ্ছে। আবার যারা ব্যর্থ হচ্ছে তাদের হয়তো ছেলেটি বা মেয়েটি বলছে যে সে তাকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবে না বলেই প্রেম করা সম্ভব নয়। কাজেই, এই চিন্তাগুলো থেকে প্রভাবিত হয়েই কিন্তু আমি গানটি লিখেছিলাম। আর গানটি লেখা হয়েছিল আমার বাড়ির ছাদে বসে। আমি সাধারণত গানের কথা আর সুর একই সাথে করি। আর এভাবে পুরো গানটি দাঁড় করাতে আমার সময় লেগেছিল প্রায় এক সপ্তাহের মতো। প্রথম দিকে গানটি আমার খুব একটা পছন্দ ছিল না বলে কোনো অ্যালবামে এটি দেইনি। তবে প্রথম বারের মতো আমার এক বন্ধুর জন্মদিনে যখন গানটি গেয়ে শোনাই তখন সবাই গানটি খুব পছন্দ করেছিল। এমনকি দু’একজন তো বিশ্বাসই করেনি যে গানটি আমার লেখা, সুর করা। যাই হোক, সবার অনুপ্রেরণা আর ভাললাগা থেকেই পরবর্তী সময়ে ‘বন্ধু ভাবো কি’ অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাক হিসেবে এই গানটি রাখি। এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার অন্য অনেক প্রিয় গানের চাইতেও এই গানটি অনেক অনেক বেশি শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করে।
বই কিনতে গিয়েছিলাম নীলক্ষেত। বই কেনা শেষে ফিরছিলাম রিকসা দিয়ে। দিনটা সকাল বেলা থেকেই খুব মেঘলা ছিল। নিউমার্কেট থেকে রিকসায় ওঠা মাত্রই শুরু হয়ে গেল ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির তালে তালে চলছে রিকসা, আর আমি বসে আছি একা। আকাশের দিকে তাকালাম, মনটা দারুণ উদাস হয়ে গেল। আমি আবার প্রায়ই কবিতা লিখতাম। ওইদিনের সুন্দর সময়টাতে হঠাৎ পেয়ে গেলাম কয়টি কবিতার লাইন। সাথে কাগজ ছিলনা তাই মোবাইলের মেসেজ অপশানে গিয়ে লিখে ফেললাম—‘বৃষ্টি ঝরে যায় দুচোখে গোপনে’। এভাবেই সৃষ্টি এই গানের কথা। সুরটাও পেয়েছিলাম আরেক বৃষ্টির দিনে। একা একা মোহাম্মদপুরে বাসার কাছেই হাঁটছিলাম। গুনগুন করতে করতে সুর করে ফেলেছিলাম গানটির। কিন্তু গায়ক হবার কোনো স্বপ্ন আমার কোনোদিন ছিলনা। আমি তখন কিবোর্ড শিখতাম এলাকারই মিউজিশিয়ান টফি রেনার ভাইয়ের কাছে। কথাচ্ছলে একদিন গানটা তাকে গেয়ে শুনালাম। তিনি বললেন,‘তৌসিফ খুবই ভালো হয়েছে’। আরও বললেন, এই গান শ্রোতারা পছন্দ করবে। তারপর হঠাৎ করেই একদিন আমি আর টফি ভাই মিলে গানের মিউজিক করে ফেললাম। ভোকাল দেবার পর সত্যিই অন্যরকম চিন্তা মাথায় চলে এল। পাশাপাশি টফি ভাইও বললেন যে, আমি যেন এই গান নিয়ে কোনো মিউজিক কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করি। ব্যাস নিজের শখ আর বাদ্যশিক্ষকের কথায় একদিন গিয়েছিলাম জি-সিরিজ কোম্পানিতে। সেখানে কথা হয় জি-সিরিজের মালিক খালিদ ভাইয়ের সাথে। তিনি গান শুনেই বলে দিলেন, যত শীঘ্রই সম্ভব পুরো অ্যালবামের কাজ শেষ করতে। আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম। এমন অফার পাবার পরে আর কেন বসে থাকা! অনেক পরিশ্রম আর খেটেখুটে রেডি করলাম জীবনের প্রথম অ্যালবাম ‘অভিপ্রায়’। খালিদ ভাই পছন্দ করলেন এবং জি-সিরিজের ব্যনারেই আমার এই গানটি পৌঁছাল শ্রোতাদের কাছে । আমার এখনও মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে যে, আমার কোনোদিনই গাইবার কথা ছিলনা—সেই আমিই ‘বৃষ্টি ঝরে যায়’ গানের জন্য বনে গিয়েছিলাম হিট গায়ক তৌসিফ।
জি-সিরিজের ব্যানারে ২০০৬ সালে বাজারে আসে কণ্ঠশিল্পী তৌসিফের প্রথম একক গানের অ্যালবাম ‘অভিপ্রায়’। অ্যালবামের ‘বৃষ্টি ঝরে যায় দুচোখে গোপনে’—শিরোনামের গানটি শ্রোতাদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়।
জি-সিরিজের ব্যানারে ২০০৬ সালে বাজারে আসে কণ্ঠশিল্পী তৌসিফের প্রথম একক গানের অ্যালবাম ‘অভিপ্রায়’। অ্যালবামের ‘বৃষ্টি ঝরে যায় দুচোখে গোপনে’—শিরোনামের গানটি শ্রোতাদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়।
হৃদয় মিক্সড শিরোনামের অ্যালবামটিতে আমার কম্পোজিশনে যে গানগুলো ছিল তার মধ্যে এই গানটি আমার বিশেষ ভাললাগার একটি গান। আমি যেদিন গানটি লিখতে বসি সেদিন বাইরে খুব বৃষ্টি বৃষ্টি একটা আবহাওয়া ছিল। আর এ ধরনের আবহাওয়াতেই আমার জীবনে খুব মন খারাপ করা একটা ঘটনা ঘটেছিল। যেকোনো কারণেই হোক সেদিনের পরিস্থিতির সাথে আমি আমার আগের দুঃখের ঘটনার একটা যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমার অধিকাংশ গানের মতো এই গানটিরও টিউন আগে করা, গানের কথা পরে লেখা। সম্ভবত মন খারাপ করা পরিস্থিতির কারণেই ওদিন আমার করা টিউনের মধ্যে একটা ‘স্যাড’ ভাব চলে আসছিল। এই দুঃখ দুঃখ সুর আর সেই সাথে আমার মনের অবস্থা মিলিয়েই তৈরি হয় গানের কথা। তবে এই গানটির নেপথ্যে যে মানুষটির কথা না বললেই নয় সে হলো নিঝু। হৃদয় মিক্সড অ্যালবামে ওর গানও ছিল এবং আমি যে সময়টায় এই গানের টিউন করি তখন নিঝু আমার পাশেই ছিল। নিঝুর সাথেই আমি আমার মনের অবস্থাটা শেয়ার করি এবং সেখান থেকে দু’জনের আলোচনার মাধ্যমেই গানের কথাগুলো দাঁড়িয়ে যায়। জীবন হোক কিংবা সম্পর্ক, সবখান থেকেই যে মানুষকে কোনো না কোনো সময় বিদায় নিতে হতে পারে সেই দুঃখকাতরতার গল্পই উঠে এসেছে ‘জানি একদিন চলে যাবে’ গানটিতে। গানটি তৈরি হবার পর আমার এতটাই ভাল লেগেছিল যে আমি হৃদয় মিক্সড অ্যালবামে ‘মেল’ ও ‘ফিমেল’ দুটি ভার্সনেই গানটি রেকর্ড করি। এর মধ্যে ‘মহিলা’ ভার্সনটি গায় নির্ঝর আর ‘পুরুষ’ ভার্সনটিকে কণ্ঠ দেই আমি নিজেই।